An Afternoon in Summer

একটি স্মৃতি রোমন্থনকারী চিত্রকাব্য

লিখেছেন সায়নী ভৌমিক

An Afternoon in Summer
Touch the link to watch the visual poetry

শৌভিক পন্ডিত এর “An Afternoon in Summer”চিত্রকাব্যটি দেখার পর এবং তার সাথে এই বিষয়ে কথা বলার পর আমার মনে হয়েছে, এই চিত্রকাব্যটি বানানোর পেছনে মূলত দুটি চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।এক, দার্শনিক দিক আর দ্বিতীয়টি খুব সরল স্মৃতি রোমন্থনের দিক।
চিত্রকাব্যটি শুরুর প্রথমেই পর্দায় ভেসে ওঠে কয়েকটা পংক্তি যার সারাংশ অনেকটা এরকম, বহুকাল আগে গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকেলে পাখির কলরবের মতো সুন্দর একটি সঙ্গীত শোনা যাচ্ছিল এবং সেই সঙ্গীতটি বারবার বিঘ্নিত হচ্ছিল শ্রুতিকটূর একটি আওয়াজের দ্বারা।

Clip from the visual poetry


আমরা যখন কথা বলি সেগুলো অধিকাংশ সময় হয় অগভীর, অনেকটা আন্তরিকতার অভাব থাকে তার কারণ আমাদের বেশিরভাগ চিন্তাভাবনা পড়ে থাকে ব্যাকরণের দিকে।ব্যাকরণগত ভাবে ভুল না করা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে ঠিক থাকার যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা তা আমাদের এতই ব্যস্ত করে তোলে যে অনেক সময় আমরা ভুলেই যাই আমরা যে কথাগুলো বলছি তার মধ্যে কি আদেও কোনো গভীরতা রয়েছে? এই বিষয়টিকে অবশ্যই আর একটি বিষয়ের সাথে তুলনা করা হয়েছে, সেটি হলো আমরা যখন আমাদের অন্তরাত্মার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করি, সেই চেষ্টাটাও যেন ঠিক ওই সুন্দর সঙ্গীতটির মতই কথার শব্দ দ্বারা বিঘ্নিত হয়।
ঠিক তারপরই আমরা দেখতে পাই পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ কিছু মুহূর্ত যার মধ্যে না আছে কোনো জটিলতা না আছে দার্শনিকতা, যা আমরা বহুকাল আগে আমাদের শৈশবে ফেলে এসেছি।

Clip from the visual poetry

একসময় আমরা এরকম রেডিওতে পুরোনো দিনের গান শুনতাম, যেগুলো আমাদের মনে সারাজীবন থেকে যাবে, যা আমাদের বারবার পুরোনো দিনে ফিরে যেতে বাধ্য করে।মনের কোথাও যেন একটু দুঃখ দেয় আবার যেন কোথাও ভালো লাগা তৈরি করে।এখন শুধুই আমরা সেই বিকেলগুলোর স্মৃতিচারণ করতে পারি ঠিক ছাদে থাকা ওই মানুষটির মত।কোথাও যেন একটু বাস্তবতার ছোঁয়া রাখার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
সবশেষে এটাই বলা যেতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে মানুষ তাদের উজ্জ্বলতম দিক প্রদর্শন করার যে ইঁদুর দৌড়ে ব্যস্ত ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এই চিত্রকাব্যটি হলো পুরোনো দিনের স্মৃতি ঘেটে ক্ষনিকের আনন্দ পাওয়ার এক প্রচেষ্টা মাত্র।

Clip from the visual poetry

“Smile of the Death”…

An abstract visual poetry by Sauvik Pandit

“Smile of the Death” An abstract visual poetry by Sauvik Pandit

শব্দের পর শব্দ বসে কাব্য হয়,ছবির পাশে ছবি বসিয়ে কিছু শব্দ যোগেও হয়তো কবিতা লেখা যায়। ‘Smile of the death’ একটি সেরকমই বিমূর্ত কবিতা। শব্দের তাৎপর্য আর চিত্রের অভিঘাত যে অর্থের প্রকাশ ঘটায়, তা কল্পকথায় এক রূঢ় বাস্তবের আখ্যান।

The Nameplate of ‘Smile of the Death’

বহু খণ্ডচিত্রের পাশাপাশি বসে যে অভিঘাত সৃষ্টি করে তা যেমন মন্তাজের রীতিতে অর্থবহ হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই তীক্ষ্ণ ছন্দের অবতরণ ঘটায়। এই চিত্রকাব্য অনুধাবন করে এক প্রশ্নের আর তার সার্বিক উত্তর দেয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির থেকে। এখানে পংক্তি গঠিত হয়েছে নানাবিধ প্রতীকের মাধ্যমে, চিত্রভাষায় বিমূর্ততার মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে এক চিরন্তন কাহিনী।

একটি পাখা ঘুরছে
(frame from ‘smile of the death’)

একটি পাখা ঘুরছে। পাখাটি চলছে, একটি গতিতে ঘুরছে পাখার ব্লেডগুলি; ঠিক যেভাবে একটি গতিতে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে বা পৃথিবী নিজেই নির্দিষ্ট একটি গতিতে আবর্তিত হয়, ঠিক সেভাবেই পৃথিবীর বুকেও একটি গতিময়তা রয়েছে, সময়ের সাথে সাথে ঘটনাপ্রবাহের গতিময়তা চিরন্তন। তারই প্রতীক এই দৃশ্যের আবহে শোনা যায় এক ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরণন। এই দৃশ্য খণ্ডকারে ফিরে ফিরে আসে বারবার সেই গতিময়তার ধারাবাহিকতার প্রতীক হিসেবে এবং তার সাথেই ফিরে ফিরে আসে সেই সংশ্লিষ্ট আবহসঙ্গীত, যা প্রতীকীবাদের তাৎপর্যে সেই দৃশ্যকে এক ছন্দের রূপ দেয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সংগৃহিত চিত্র

সেই আবহের সুর কেটে যায় হঠাৎ,ফুটে ওঠে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক ভয়াবহ বিধ্বংসী কালখণ্ডের সংগৃহীত চিত্র। যুদ্ধ হচ্ছে, আবহে Bert Hare এর “I’m Dying, Mother” গানের সুর-কথা। সেই সুর কেটে কেটে বারবার দেখা যায় সেই চিরন্তন ঘূর্ণায়মান পাখা আর তার সাথে তার নির্দিষ্ট আবহের সুর। চলতে থাকে এই দুই দৃশ্য ও তাদের আবহগীতের আনাগোনা; বারবার সুর, তাল, ছন্দ কেটে যেন দৃশ্যের স্থায়িত্ব হরণ করে এই আসা-যাওয়া, যেন ছন্দ তৈরি নয়, উদ্দেশ্য ছন্দপতন ঘটানো।

এক টুকরো আকাশ
(frame from ‘smile of the death’)

তারপর এক অন্ধকার ঘরের জানলার এক পাল্লার ফাঁকা দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখা যায়। দূরের সেই আকাশ যেন ধূসর ধোঁয়ায় ঢাকা, চোখ আর আকাশের মাঝে জানলার গরাদ যেন অদ্ভুত বক্রাকারে দূরত্ব এঁকে দিয়েছে। আবহে সেই শাস্ত্রীয় সুরের ঝঙ্কার।

এক পরিত্যক্ত বাড়ি
(frame from ‘smile of the death’)

যুদ্ধ তবুও চলছে, তার আবহে শোনা যাচ্ছে এখনও “I’m Dying, Mother” এর সুর। কিন্তু সেই দৃশ্য ক্ষণস্থায়ী, হঠাৎ তা সরে গিয়ে দেখা যায় এক পরিত্যক্ত বাড়ি। জানলার পাল্লার এক ফাঁকে চোখ রেখে দেখা যায় একটি ভগ্নপ্রায় আবাস, অযত্নে পড়ে থাকা কিছু ফটো ফ্রেম, কিছু ব্যবহার অযোগ্য সামগ্রী। পরিত্যক্ত বাড়িটির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যেন যুদ্ধ এর সেই ভয়াবহতার সাক্ষী হয়ে রয়েছে সেই বাড়িটির কঙ্কাল।

জানালা-লোহার শিক-জেলের গরাদ
(frame from ‘smile of the death’)

আবার যুদ্ধের একটি দৃশ্য এসে ছন্দপতন ঘটিয়ে উপনীত করে অপর এক দৃশ্যে। জানালা দিয়ে দেখা যায় এক সরু গলি। তবে যেহেতু জানালা দিয়ে দেখা যায়, তাই বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। কারণ জেলের গরাদের মতো জানলায় লোহার শিক যা দিয়ে বাইরে দেখা গেলেও এই বন্দিদশা থেকে মুক্তির দরজা সেটা নয়। সেই দৃশ্যের মাঝেই আগন্তুকের মতো আরও একবার ঘুরে যায় বিশ্বযুদ্ধের গতিময়তা। তারপর আবার সেই জানালা-লোহার শিক-জেলের গরাদ ইত্যাদি ইত্যাদি।

এক বরফাচ্ছাদিত গুহা
(frame from ‘smile of the death’)

এইবার আবহে শোনা যায় সুদুর জর্জিয়ার এক পার্বত্য লোকগান “Mtielta tamashobani”, তার সাথেই ফুটে ওঠে এক বরফাচ্ছাদিত গুহার দৃশ্য, যেখানে কালচক্র স্থগিত রয়েছে বহুযুগ থেকে, যেখানে সংরক্ষিত প্রতিটি বিধ্বংসী ঘটনা, প্রতিটি যুদ্ধে মারা যাওয়া সৈনিকের মৃতদেহ।

প্রতিবিম্ব
(frame from ‘smile of the death’)

আয়ানায় ফুটে ওঠে ঘরের দেওয়াল, ঘুলঘুলির, ক্যালেন্ডারের প্রতিবিম্ব। প্রতীকীবাদে বলে যায় বন্দীর সময়ের হিসেব-নিকেশ।

আসা-যাওয়ার মাঝের দরজা
(frame from ‘smile of the death’)

প্রতিবিম্বে দেখা যায় ঘরের দরজা একবার খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়, তবে তা বাইরে বেরোনোর দরজা নয়, সেই দরজা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে আসা-যাওয়ার মাঝের দরজা আর আবহে শোনা যায় মুক্তির জয়গান। এ যেন ছন্দ তৈরি করে নিজেই সেই ছন্দ ভাঙা,গড়া-ভাঙার এক নিরন্তর ধারাবাহিকতা।

আলোকবিন্দু
(frame from ‘smile of the death’)

যুদ্ধ, ঘুরে চলা সেই পাখা, বরফে ঢাকা গুহার দৃশ্য পরপর অবস্থানে এক অদ্ভুত অভিঘাতের সৃষ্টি হয়, মন্তাজ বর্ণনা করে এক চিরন্তন প্রশ্ন-উত্তর পর্বের। থেমে যায় আবহসঙ্গীত, ধীরে ধীরে মুছে যায় দৃশ্যাবলী। অন্ধকারে দেখা যায় ছোট্ট এক আলোকবিন্দু, তা ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক-ওদিক, ওপর-নীচে। তার এক আশ্চর্য অস্থিরতা আছে, সে থেমে থাকতে পারে না। এই সময় আবহে শোনা যায় বিপদসংকুল আফ্রিকার অধিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী এক লোকগান। তৈরি হয় নতুন ছন্দ, শুরু হয় অন্তরাত্মার অশেষ খোঁজ।


গলিপথ-যুদ্ধক্ষেত্র-বরফাচ্ছাদিত গুহা-পাখা
(frame from ‘smile of the death’)

তারপরই দ্রুতগতিতে বয়ে যায় যুদ্ধের ভয়াবহ বীভৎসতা, গতি অতিক্রম করে সময়ের মাপ। ফুটে ওঠে চারটি দৃশ্য – জানলার গরাদের ফাঁকা দিয়ে দেখা যায় সেই বাইরের গলিপথ- যুদ্ধক্ষেত্রের সেই মৃত্যু উৎসব-সময়ের চাকা থেমে থাকা সেই বরফাচ্ছাদিত গুহা-অনন্তকাল ধরে ঘুরে চলা সেই পাখা।

জানালার গরাদ আর হিমশীতল গুহার ছাদ মুছে যায়
(frame from ‘smile of the death’)

ধীরে ধীরে জানালার গরাদ আর হিমশীতল গুহার ছাদ মুছে যায়, তারপর অদৃশ্য হয় যুদ্ধক্ষেত্র, শুধু চলতে থাকে সেই পাখা, ঘুরতে থাকে মহাজাগতিক গতিময়তার অক্লান্ত প্রতীকরূপে।

অদৃশ্য হয় যুদ্ধক্ষেত্র
(frame from ‘smile of the death’)

ইতিহাসের সাক্ষ্য সময়ের কণায় সেই বরফে ঢাকা গুহায় সংরক্ষিত রয়েছে, যাতে লেখা রয়েছে যুদ্ধের কারণ, সময়, ঘটনা, ফলাফল,
লাভ-লোকসান, জয়-পরাজয়, রয়েছে সমাধিতে খোঁদায় করা অগনিত নাম, রয়েছে অনন্ত বন্দিজীবন আর চিরন্তন গতিময়তা। সেই উৎসব যা চলেছিল বিশ্বব্যাপী, বহুসময় ধরে, যা ভগ্নপ্রায় করেছিল সমগ্র আবাসভূমি, সেই নরকে ছিল কেবল একটি হাস্যরত মুখ, সেই মুখ হল মৃত্যুর, সেই মুখে ছিল এক তাচ্ছিল্যপূর্ণ মৃত্যুর হাসি।

Written by Sauvik Pandit, Dept. Of Film Studies, Jadavpur University.